১৯৭১ সালে সংঘঠিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে একটি স্বাধীন দেশ ‘বাংলাদেশ’। এই স্বাধীনতার বীজ রোপিত হয়েছিল ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পর পরই। ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হয়ে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান এবং হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ভরত। নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তান দুই হাজার মাইলের ব্যবধানে অবস্থিত দুটি প্রদেশের সমন্বয়ে গঠিত হয় - পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানে বাংলাদেশ) ও পশ্চিম পাকিস্তান। ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বিস্তর পার্থক্য থাকলেও মিল ছিল কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতেই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সাথে বিমাতাসূলত আচরণ করতে থাকে। স্বাধীন হওয়ার পূর্বে পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসন ছিল কেবলমাত্র শোষণ আর বঞ্চনার ইতিহাস।
পটভূমি:
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের ইতিহাসের সামান্যই নিম্নে আলোকপাত করা হলো।
অর্থনৈতিক বৈষম্য:
পাকিস্তান সৃষ্টি পর হতেই পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য দিন দিন প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। মোট জাতীয় বাজেটের সিংহভাগ বরাদ্দ থাকত পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। এদেশের জনগণ হতে থাকে অর্থনৈতিক বঞ্চনার চরম শিকার। এ কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তান সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়ে এবং মানুষের মনে ক্ষোভ দানা বাঁধতে শুরু করে।
ভাষা আন্দোলন:
পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই শুরু হয় পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক আচরণ। কেবল অর্থনৈতিক শোষণ নয়, বাঙ্গালী সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপরও নিপীড়ন শুরু হয় এবং এর প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয় যখন পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় এসে ঘোষণা দেন ‘উর্দু এবং কেবলমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’। সাথে সাথে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনতা এই ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্যে এই আন্দোলন তীব্রতম রূপ ধারণ করে। এসময় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর সহ আরো অনেকে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিতে হয়। আজ পৃথিবীব্যাপী ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়।
সামরিক বৈষম্য:
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে বাঙ্গালীরা অবহেলিত ছিল। সমগ্র সশস্ত্র বাহিনীর মাত্র ৫ শতাংশ ছিল বাঙ্গালী অফিসার। এদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল প্রযুক্তিগত ও ব্যবস্থাপনা পদে। খুব অল্প সংখ্যক বাঙ্গালী অফিসার আদেশদানকারী পদ লাভের সুযোগ পেতেন। পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিশ্বাস করত বাঙ্গালীরা পশতুন বা পাঞ্জাবীদের মত ‘সাহসী’ নয়। পাকিস্তানের বাজেটের একটি বিশাল অংশ সামরিক খাতে বরাদ্দ থাকলেও পূর্ব পাকিস্তান এর সুফল সামান্যই পেত। ১৯৬৫ সালে কাশ্মির নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঙ্গালীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি আরও বাড়িয়ে দেয়।
রাজনৈতিক বৈষম্য:
পাকিস্তান সৃষ্টির শুরু থেকেই শাসনের নামে পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়, আর এই ষড়যন্ত্রে মূল ভূমিকা পালন করে সামরিক বাহিনী। যখনই পূর্ব পাকিস্তানের কোন নেতা, যেমন খাজা নাজিমুদ্দিন, মোহাম্মদ আলী অথবা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হতেন, তখনই পশ্চিম পাকিস্তানীরা কোন না কোন অজুহাতে তাদের পদচ্যুত করত। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান অবৈধভাবে পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করে এবং দীর্ঘ ১১ বছর ধরে পাকিস্তানে তার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন চালু রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই অনৈতিক ক্ষমতা দখল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়েই চলে। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তর অংশ হওয়া সত্ত্বেও দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তান কুক্ষিগত করে রাখে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে ক্ষমতার বন্টন পূর্ব পাকিস্তানের অনুকূল হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান “এক ইউনিট তত্ত্ব” নামে এক অভিনব ধারণার সূত্রপাত করে, যেখানে সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তান একটি প্রদেশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের ভোটের ভারসাম্য আনা। মজার ব্যাপার হল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাঞ্জাব প্রদেশ প্রস্তাব করে পাকিস্তানে সরাসরি জনসংখ্যার বন্টনের ভিত্তিতে ভোট অনুষ্ঠিত হোক, কারণ পাঞ্জাবিরা ছিল সিন্ধি, পশতুন, বালুচ বা পাকিস্তানের অন্য যেকোন গোত্রের তুলনায় সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এছাড়া শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ বাড়তে থাকে দিনকে দিন যার বিরূপ প্রভাব পড়তে থাকে এদেশের সাধারণ জনগণের মনের গহীনে, স্বাধীনতার আকাঙ্খায় নিরবে দিন পাড় করতে থাকে মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায়।
১৯৭০ সালের সাইক্লোন:
১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে এক সাইক্লোন আঘাত হানে। স্মরণকালের সেই ভয়াবহ সাইক্লোনে প্রায় ৩-৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। নেমে আসে অবর্ননীয় দুর্যোগ। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে এমন ভয়াবহ দুর্যোগে জরুরিভাবে ত্রাণ কার্য পরিচালনা করতে নির্লজ্যভাবে গরিমসি করে। সরকারি সহায়তার অভাবে বেঁচে যাওয়া অনেক মানুষ খাবার ও পানির অভাবে মৃত্যুবরণ করে। এক সপ্তাহ পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান স্বীকার করে, দুর্যোগের ভয়াবহতা বুঝতে না পারার কারণে সঠিকভাবে ত্রাণকার্য পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা আর বর্বর আচরণ দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। মাওলানা ভাসানী ২৪শে নভেম্বর এক সভায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে অদক্ষতার অভিযোগ তোলেন এবং অবিলম্বে তার পদত্যাগ দাবি করেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা একটি দেশে গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৭০-এর নির্বাচন ও ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ:
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় দল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হলে ৩১৩ আসনবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদ আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের অধিকার প্রদান করে। কিন্তু নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন। তিনি প্রস্তাব করেন পাকিস্তানের দুই প্রদেশের জন্যে থাকবে দু'জন প্রধানমন্ত্রী। “এক ইউনিট কাঠামো” নিয়ে ক্ষুব্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে এরূপ অভিনব প্রস্তাব নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করে। ভুট্টো মুজিবের ৬ দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি জানায়। মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ হয় না। মুজিব সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। এই ভাষণে তিনি ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই বাস্তবায়নের জন্য চার দফা দাবি পেশ করেন:
(ক) অবিলম্বে মার্শাল ল প্রত্যাহার করতে হবে।
(খ) সামরিক বাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যেতে হবে।
(গ) নিহত ব্যক্তিদের সঠিক সংখ্যা অনুসন্ধান করতে হবে।
(ঘ) ২৫শে মার্চে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
শেখ মুজিব তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তাঁর এই ভাষণ গোটা জাতিকে স্বাধীনতার আকাঙ্খায় উন্মাতাল করে তোলে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠনের অধিকার অর্জন করলেও পাকিস্তানের সামরিক সরকার শাসন ক্ষমতা কোন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ছেড়ে দিতে রাজি ছিল না। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ নির্ধারিত হলেও ভেতরে ভেতরে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং সামরিক বাহিনীর অফিসারদের নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের নীলনক্শা তৈরী করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোন কারণ ছাড়াই ৩ তারিখের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করা হয়। এই সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙ্গে যায়, সারা দেশে বিক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়। মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় ঢাকা। বঙ্গবন্ধু সারা দেশে ৫ দিনের হরতাল এবং অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তার আহবানে সারা পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে যায়। সামরিক সরকার কারফিউ জারি করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেও বাঙ্গালিদের রাজপথ থেকে সরাতে ব্যর্থ হয়। ৫ দিন হরতাল শেষে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন।
মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক, ঢাকায় গোপনে পাকিস্তানী সেনা ও যুদ্ধের রসদ:
সারা দেশ যখন বিক্ষোভে উত্তাল, তখন কুচক্রী ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এসে শেখ মুজিবের সাথে সরকার গঠন ও ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে লোক দেখানো আলোচনা শুরু করে। আর গোপনে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালানোর প্রস্তুতি নিতে থাকে। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বেলুচিস্তানের কসাই হিসেবে পরিচিত জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু কোন বাঙ্গালী তাকে শপথ পাঠ করাতে রাজি হননি। গণহত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ১০ থেকে ১৩ মার্চের মধ্যে পাকিস্তান এয়ারলাইন্স তাদের সব আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল করে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরীভিত্তিতে ‘সরকারি যাত্রী’ পরিবহণ করতে। এই ‘সরকারি যাত্রী’দের প্রায় সবাই ছিল সাদা পোশাকে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর সেনা। এমভি সোয়াত নামে গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি পাকিস্তানী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়লে বন্দরের নাবিক ও শ্রমিকেরা তা খালাস করতে অস্বীকার করে। পাকিস্তানী কমান্ডার তাদের উপর গুলি চালাতে আদেশ দিলে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি দল গুলি চালাতে অস্বীকার করে, যার মাধ্যমে শুরু হয় বাঙ্গালী সৈনিকদের বিদ্রোহ। অনেক আশা সত্বেও মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সফল হয় না। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীকে বাঙ্গালি নিধনযজ্ঞের সবুজ সংকেত প্রদান করে সন্ধ্যায় গোপনে ঢাকা ত্যাগ করে।
অপারেশন সার্চ লাইট:
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামের গণহত্যাযজ্ঞ। যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙ্গালি প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দেয়া। এরই অংশ হিসাবে সামরিক বাহিনীর বাঙ্গালি সদস্যদের নিরস্ত্র করে হত্যা করা হয়, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সমাজ নিধন করা হয় এবং সারা বাংলাদেশে নির্বিচারে সাধারণ মানুষ হত্যা করা হয়।
হত্যাকান্ডের খবর যাতে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে না পৌঁছায় সে লক্ষ্যে ২৫ মার্চের আগেই বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা ত্যাগে বাধ্য করা হয়। সাংবাদিক সাইমন ড্রিং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকায় অবস্থান করে ওয়াশিংটন পোস্টের মাধ্যমে সারা পৃথিবীকে এই গণহত্যার খবর জানিয়েছিলেন। প্রথমে এই হত্যাযজ্ঞের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল ঢাকা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ছিল তাদের বিশেষ টার্গেট। জগন্নাথ হল পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। এতে ৬০০ থেকে ৭০০ আবাসিক ছাত্র নিহত হয়।
বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার ও স্বাধীনতার ঘোষণা:
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্য রাতে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন। ঘোষণা করা হয় দেশের স্বাধীনতার। ২৬শে মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ঘোষণাটির অনুবাদ হচ্ছে : আমি, মেজর জিয়া, বাংলাদেশ লিবারেশন আর্মির প্রাদেশিক কমান্ডার-ইন-চীফ, শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি। আমি আরো ঘোষণা করছি যে, আমরা শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একটি সার্বভৌম ও আইনসিদ্ধ সরকার গঠন করেছি যা আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার জোট-নিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতে বদ্ধপরিকর। এ রাষ্ট্র সকল জাতীর সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং বিশ্বশান্তির জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। আমি সকল দেশের সরকারকে তাদের নিজ নিজ দেশে বাংলাদেশের নৃশংস গণহত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার একটি সার্বভৌম ও আইনসম্মত সরকার এবং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবার দাবিদার।
তবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মনে করে, বঙ্গবন্ধু ২৫মে মার্চ রাতের শেষভাগে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। যার অনুবাদ হচ্ছে : এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উত্খাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।
অস্থায়ী সরকার গঠন:
মুক্তিযুদ্ধ জন্য ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা) বৈদ্যনাথতলার অন্তর্গত ভবেরপাড়া (বর্তমান মুজিবনগর) গ্রামে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান এর অনুপস্থিতিতে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠন করা হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দ্বায়িত্ব নেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পিত হয় তাজউদ্দীন আহমদ এর উপর। মন্ত্রী হিসেবে যোগ দেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান। দেশী-বিদেশী সাংবাদিকের সামনে শপথ গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিক ভাবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন বাংলাদেশের প্রথম সরকার। এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে ২৬ মার্চ হতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
সেক্টর কমান্ডার গঠন:
দক্ষ ও পরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য প্রবাসী সরকার দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন। কর্ণেল এম এ জি ওসমানীকে কমান্ডার ইন চিফ, লেফট্যানেন্ট কর্ণেল আবদুর রবকে চিফ অফ আর্মি স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খোন্দকারকে ডেপুটি চীফ অফ আর্মি স্টাফ ও চিফ অফ এয়ার ফোর্সের দায়িত্ব দেয়া হয়।
১নং সেক্টর:
অঞ্চল: চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ফেনী নদী পর্যন্ত। কমান্ডার: (ক) মেজর জিয়াউর রহমান (এপ্রিল-জুন), (খ) মেজর মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (জুন-ডিসেম্বর)
২নং সেক্টর:
অঞ্চল: নোয়াখালী জেলা, কুমিল্লা জেলার আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত এবং ফরিদপুর ও ঢাকার অংশবিশেষ। কমান্ডার: (ক) মেজর খালেদ মোশাররফ (এপ্রিল-সেপ্টেম্বর) (খ) মেজর এ.টি.এম. হায়দার (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)।
৩নং সেক্টর:
অঞ্চল সিলেট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমা, কিশোরগঞ্জ মহকুমা, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে কুমিল্লা ও ঢাকা জেলার অংশবিশেষ। কমান্ডার: (ক) মেজর কে. এম. শফিউল্লাহ (এপ্রিল- সেপ্টেম্বর), (খ) মেজর এ. এন. এম. নুরুজ্জামান (সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর)।
৪নং সেক্টর:
অঞ্চল: সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই-শায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট-ডাউকি সড়ক পর্যন্ত। কমান্ডার: মেজর সি.আর. দত্ত।
৫নং সেক্টর: সিলেট-ডাউকি সড়ক থেকে সিলেট জেলার সমগ্র উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল। কমান্ডার: মীর শওকত আলী।
৬নং সেক্টর:
অঞ্চল: সমগ্র রংপুর জেলা এবং দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমা। কমান্ডার: স্কোয়াড্রন লিডার মোহাম্মদ খাদেমুল বাশার।
৭নং সেক্টর:
অঞ্চল: দিনাজপুর জেলার দক্ষিণাঞ্চল, বগুড়া, রাজশাহী এবং পাবনা জেলা। কমান্ডার: (ক) মেজর নাজমুল হক (এপ্রিল-আগষ্ট, দুর্ঘটনায় নিহত), (খ) মেজর কাজী নুরুজ্জামান।
৮নং সেক্টর:
অঞ্চল: সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুরের অধিকাংশ এলাকা এবং দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশ। কমান্ডার (ক) মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (এপ্রিল- আগস্ট), (খ) মেজর এম. এ. মনজুর (আগষ্ট-ডিসেম্বর)।
৯নং সেক্টর:
অঞ্চল: দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়ক থেকে খুলনার দক্ষিণাঞ্চল এবং সমগ্র বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা। কমান্ডার: (ক) মেজর এম. এ. জলিল (এপ্রিল-ডিসেম্বর প্রথমার্ধ), (খ) মেজর জয়নুল আবেদীন (ডিসেম্বরের অবশিষ্ট দিন)।
১০নং সেক্টর:
কোনো আঞ্চলিক সীমানা নেই। নৌবাহিনীর কমান্ডো দ্বারা গঠিত। শত্রুপক্ষের নৌযান ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হত।
১১নং সেক্টর:
অঞ্চল: কিশোরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ি-আরিচা থেকে ফুলছড়ি-বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী ও তীর অঞ্চল। কমান্ডার: (ক) মেজর জিয়াউর রহমান (জুন - অক্টোবর), (খ) মেজর আবু তাহের (অক্টোবর-নভেম্বর), (গ) ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ (নভেম্বর-ডিসেম্বর)।
টাঙ্গাইল সেক্টর: সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা ছাড়াও ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার অংশে কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন কাদের সিদ্দিকী।
আকাশপথ: বাংলাদেশের সমগ্র আকাশসীমা, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার।
১০ নং সেক্টরটি ছিল কমান্ডার ইন চীফের (সি-ইন-সি) সরাসরি তত্ত্বাবধানে, যার মধ্যে নৌ-বাহিনী ও সি-ইন-সির বিশেষ বাহিনীও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে উপযুক্ত কোন অফিসার ছিল না বলে ১১ নং সেক্টরের (নৌ সেক্টর) কোন সেক্টর কমান্ডার ছিল না; এ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা যখন যে সেক্টরে অপারেশন চালাতেন, তখন সে সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের অধীনে থাকতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশির ভাগ ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল সীমান্ত এলাকায় এবং ভারতের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ লাভ করত। সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করার জন্যে তিনটি ব্রিগেড (১১ ব্যাটালিয়ন) তৈরি করা হয়। এছাড়াও প্রায় ১,০০০ মুক্তিযোদ্ধাকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের ভেতরে নিয়মিত বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানো হতো।
দীর্ঘ নয় মাস ধরে চলে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ:
পাকিস্তানী বাহিনীর পরিকল্পনা ছিলা ঢাকায় গণহত্যার চালানোর মাধ্যমে ১০ এপ্রিলের মধ্যে সারা বাংলাদেশ নিজেদের আয়ত্তে আনা। কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এবং ছাত্র ও সাধারণ জনতা তাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রামে বাঙ্গালী সেনাবাহিনীর সদস্য ও ইপিআর এর সদস্যরা বিদ্রোহ করে শহরের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। চট্টগ্রাম শহরের নিয়ন্ত্রণ পেতে পাকিস্তানী বাহিনীকে যুদ্ধজাহাজ থেকে গোলাবর্ষণ করতে হয় এবং বিমান আক্রমণ চালাতে হয়। কুষ্টিয়া, পাবনা, বগুড়া, দিনাজপুর ইত্যাদি জেলাতেও বাঙ্গালী সেনারা বিদ্রোহ করে নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা বিপুলসংখ্যক সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রের বলে মে মাসের শেষ নাগাদ এসব মুক্তাঞ্চল দখল করে নেয়।
মার্চের শেষদিক হতেই পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এ সময় বৃদ্ধ, মহিলা, শিশুসহ নিরহ মানুষ দলে দলে ভারত সীমান্তের দিকে পালাতে শুরু করে। এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া শরণার্থীদের এই ¯্রােত নভেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিল এবং এ সময়ে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করে।
মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মাধ্যমে সীমান্তবর্তী বর্ডার পোস্টগুলো একে একে দখল করে নিতে শুরু করে। বাংলাদেশের নিয়মিত বাহিনী কমলপুর, বিলোনিয়া, বয়রা প্রভৃতি বর্ডার পোস্টে হামলা করে এবং ৩০৭টি পোস্টের ৯০টিই দখল করে নেয়। পাশাপাশি গেরিলা বাহিনীর হামলাও তীব্রতর হয়ে ওঠে।
পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার বাহিনীর নিয়মিত কাজ ছিল সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার করা এবং দেশপ্রেমিক বাঙ্গালীদের নির্যাতন করা। সীমান্তে ও দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণের জবাবে তারা এ অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু অক্টোবরের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়ে তারা দিনের বেলাতেও নিজেদের সামরিক ঘাঁটি থেকে বের হতে ভয় পেত। এমন পরিস্থিতিতে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জরুরী ভিত্তিতে ৫ ব্যাটালিয়ন সৈন্য তলব করা হয়।
আগস্টের পরপরই বিপুলসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ও তাদের দোসরদের ওপর হামলা চালাতে থাকে। পাকিস্তানী সামরিক ঘাঁটি থেকে শুরু করে সামরিক স্থাপনা, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট ইত্যাদি মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। গেরিলা হামলায় পাকিস্তানের চৌকষ সামরিক বাহিনীকে নাজেহাল করে তোলে স্বল্প দিনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলা যোদ্ধারা। এমনকি রাজধানী ঢাকায় ক্রাক প্লাটুন দুঃসাহসী সব অভিযান চালায়। ১৬ আগস্ট ১৯৭১ নৌ-কমান্ডোরা ‘অপারেশন জ্যাকপট’এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করে থাকা পাকিস্তানী যুদ্ধজাহাজ মাইন দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ধীরে ধীরে বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল শত্রুমুক্ত হতে শুরু করে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ:
মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণে ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অবস্থা এতটাই শোচনীয় হয়ে পড়ে যে উপায়ন্তর না দেখে ঘটনা ভিন্ন খাতে পরিচালিত করতে তারা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটায় রেডিও পাকিস্তান সংক্ষিপ্ত এক বিশেষ সংবাদ প্রচার করে যে ‘ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তজুড়ে আক্রমণ শুরু করেছে। বিস্তারিত খবর এখনো আসছে।’ পাঁচটা ৯ মিনিটে পেশোয়ার বিমানবন্দর থেকে ১২টি যুদ্ধবিমান উড়ে যায় কাশ্মীরের শ্রীনগর ও অনন্তপুরের উদ্দেশ্যে এবং সারগোদা বিমানঘাঁটি থেকে আটটি মিরেজ বিমান উড়ে যায় অমৃতসর ও পাঠানকোটের দিকে। দুটি যুদ্ধবিমান বিশেষভাবে প্রেরিত হয় ভারত ভূখন্ডের গভীরে আগ্রায় আঘাত করার উদ্দেশ্যে। মোট ৩২টি যুদ্ধবিমান অংশ নেয় এই আক্রমণে। ৩রা ডিসেম্বর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতার ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতের বিভিন্ন বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানের উল্লিখিত বিমান-আক্রমণ শুরু হয়। অবিলম্বে তিনি দিল্লী প্রত্যাবর্তন করেন। মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠকের পর মধ্যরাত্রির কিছু পরে বেতার বক্তৃতায় তিনি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে বলেন, এতদিন ধরে “বাংলাদেশে যে যুদ্ধ চলে আসছিল তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।” ভারতও এর জবাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং তাদের পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলা প্রতিহত করে। ভারতের সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে যৌথবাহিনী তৈরি করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৪ঠা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় স্থলবাহিনীর সম্মুখ অভিযান শুরু হয় চারটি অঞ্চল থেকে: (১) পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্য থেকে তিন ডিভিশনের সমবায়ে গঠিত ৪র্থ কোর সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-কুমিল্লা-
যৌথবাহিনীর প্রবল আক্রমণের মুখে সারা দেশের সীমান্তবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রগুলো থেকে পাকিস্তানীরা পিছু হটতে শুরু করে। পতন হতে থাকে একের পর এক পাকিস্তানী ঘাঁটির। পাকিস্তানীরা অল্প কিছু জায়গায় তাদের সামরিক শক্তি জড় করেছিল; যৌথবাহিনী তাদের এড়িয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঢাকার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বাংলাদেশের আপামর জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণার মাত্র ১৩ দিনের মাথায় যৌথবাহিনী ঢাকার দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। এর আগেই বিমান হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী বিমান বাহিনী পরাস্ত করে ঢাকার সকল সামরিক বিমান ঘাঁটির রানওয়ে বিধ্বস্ত করে দেয়া হয়। তৎকালীন পাকিস্তানী উর্ধ্বতন অফিসাররা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আশ্বাস পেয়েছিল উত্তরে চীন ও দক্ষিণে আমেরিকা থেকে তাদের জন্য সহায়তা আসবে, কিন্তু বাস্তবে তার দেখা মেলে না।
জাতিসংঘে কূটনৈতিক তৎপরতা:
৪ঠা ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জার নিরাপত্তা পরিষদের আহূত অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি সম্বলিত মার্কিন প্রস্তাব পেশ করার প্রস্তুতি নেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক বিবৃতিতে উপমহাদেশের সংঘাতের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ি করেন। নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন শুরু হবার পর মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, ভারত ও পাকিস্তানের সৈন্য স্ব স্ব সীমান্তের ভিতরে ফিরিয়ে নেওয়া এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদান করার জন্য এক প্রস্তাব উত্থাপন করেন। সোভিয়েত প্রতিনিধি এই প্রস্তাবকে ‘একতরফা’ বলে অভিহিত করে ভেটো প্রয়োগ করেন। পোল্যান্ডও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভোট দানে বিরত থাকে। পরদিন ৫ই ডিসেম্বরে নিরাপত্তা পরিষদের পুনরায় যে অধিবেশন বসে তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের এক প্রস্তাবে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানে এমন এক ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’ প্রয়োজন যার ফলে বর্তমান সংঘর্ষের অবসান নিশ্চিতভাবেই ঘটবে এবং পাক-বাহিনীর যে সহিংসতার দরুন পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে তাও অবলিম্বে বন্ধ করা প্রয়োজন। একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। চীন ভোট দেয় বিপক্ষে। অন্য সকল সদস্য ভোটদানে বিরত থাকে। ঐ দিন আরও আটটি দেশের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে নতুন একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন তার দ্বিতীয় ভেটো প্রয়োগ করে। একই সময়ে ‘তাস’ মারফত এক বিবৃতিতে সোভিয়েত সরকার ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি জানান। এই সংঘর্ষ সোভিয়েত সীমান্তের সন্নিকটে সংঘটিত হওয়ায়’ এর সঙ্গে সোভিয়েত নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, বলে উল্লেখ করে এবং পরিস্থিতির অবনতি রোধকল্পে বিবদমান পক্ষদ্বয়ের যে কোনটির সঙ্গে জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান।
বুদ্ধিজীবি হত্যা:
পরাজয় নিশ্চিত জেনে পাকিস্তানী আর্মির নির্দেশে এদেশীয় রাজাকার, আল বদর ও আল শামস বাহিনী স্বাধীনতার মাত্র দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ জন বুদ্ধিজীবীকে-যাদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী-ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। পাকিস্তানের পদলেহী বাংলাদেশী বিশ্বাসঘাতক রাজাকারের দল ডিসেম্বরের শুরুতেই যুদ্ধের পরিণতি বুঝতে পেরে স্বাধীনতার ঠিক আগে সুপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটায়। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের অগ্রগতির পথ বন্ধ করে দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। ১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবীদের লাশ বিভিন্ন গণকবরে ফেলে আসা হয়, যার মধ্যে রায়েরবাজার বধ্যভূমি অন্যতম।
কাঙ্খিত বিজয় ও পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ:
ডিসেম্বরের শুরুতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত সরাসরিভাবে জড়িয়ে পড়ে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণের মুখে ইতোমধ্যে পর্যদুস্ত ও হতোদ্যম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেঃ জেঃ এ. এ. কে নিয়াজী হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। বাংলাদেশের পক্ষে দলিলে স্বাক্ষর করেন ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর চীফ, অফিসার পূর্ব থিয়েটার, লে জেনারেল জগজিৎ সিং অররা। প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানী সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্খিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর নয় মাস পর। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা দেশে সকল পাকিস্তানীদের আত্মসমর্পণ করাতে সময় লাগে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের দিনই সপ্তম নৌবহর প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণতম প্রান্তে। কিন্তু বাংলাদেশ তখন পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত ‘স্বাধীন সার্বভৌম দেশ’। মূল্য হিসেবে দিতে হয়েছে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ৩ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম।
বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং শাসনভার গ্রহণ:
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তানী সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দান করে। মুক্তি পেয়ে তিনি লন্ডন, ভারত হয়ে ১০ জানুয়ারী স্বাধীন দেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন। শাসনভার গ্রহন করে তিনি আত্মনিয়োগ করেন যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পূর্ণগঠনের কঠিনতম কাজে।
No comments:
Post a Comment