Monday, August 4, 2014

সাহানার স্বপ্ন

হাসপাতালের বারান্দায় অনেক লোকের জটলা। নার্সদের ছোটাছুটি একজন রোগীকে কেন্দ্র করে। ভদ্রলোক নিজে হাসপাতালের এমার্জেন্সীতে এসেই ঢলে পড়ে যান। নার্সরা ধরাধরি করে দ্রুত এমার্জেন্সীতে নিয়ে যায়। সেখান থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পুরুষ ওয়ার্ডে। অচেতন হয়ে আছেন বিছানায়। নার্স রুমা ভদ্রলোকের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে কপাল টিপছে, চুলে হাত বুলাচ্ছে। রোগীর সাথে নিকট আত্মীয় কেউ নেই। নিজে একাই এসেছে। রোগীটি রুমার কাছে অনেক পুরনো। এর আগেও বেশ ক’বার এসেছে। রুমাকে নিজের বোন মনে করে রোগীটি। প্রথমবার যখন এখানে জ্বর নিয়ে এসে ভর্তি হয় তখন থেকেই তার সাথে এমন সখ্যতা।
ডা. সাহানা পুরুষ ওয়ার্ডের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। নিজ কামরায় ঢুকে ডেকে পাঠান নার্স রুমাকে। নতুন রোগীর মাথায় হাত বুলানো নিয়ে প্রশ্ন করে। রুমা বলে, ম্যাডাম এই রোগীর সাথে কোন আত্মীয় স্বজন কেউ নেই। আর কখনোই আসে না।
-তার মানে এই রোগী কি এর আগেও এখানে এসেছিল না-কি?
-জ্বি ম্যাডাম। এর আগে চারবার এসেছিলেন। প্রতিবারই এই হাসপাতালেই উনি আসেন। সুস্থ হয়েই ফিরে যান।


-বলো কি!
-জ্বি ম্যাডাম। একবার তো পুরো একমাস এখানে থেকে গেছেন। তখন জন্ডিস হয়েছিল। পুরো সুস্থ হয়ে তবেই চলে গেছেন।
-এই একমাসে কি উনার কোন পরিচিত লোক কেউই দেখতে আসেনি।
-জ্বি না। একজনও আসেনি। তবে ফোনে অনেকের সাথে ফোনে কথা বলেন। বাসারও খোঁজ খবর রাখেন মনে হয়। কিন্তু কোন হাসপাতালে আছেন এ কথা উনি কাউকেই বলেন না।
-তা তুমি মাথা টিপছিলে কেন?
-এখানে যখন প্রথম আসে তখন তিনি আমাকে নিজের বোন সম্বোধন করেন। আর বলেন, আমার যখন শরীর খুব খারাপ লাগে আমি যেন তার মাথাটা টিপে দেই আর চুলে হাত বুলাই। এই দুটো জিনিষ নাকি ওনাকে অনেক বেশি আরাম দেয়।
-উনার কি জ্ঞান ফিরেছে।
-জ্বি না ম্যাডাম, শীররে অনেক জ্বর। একশত তিনের উপরে। ম্যাডাম আপনি কি একবার দেখবেন?
-হ্যাঁ, চলো তো দেখি, বলেই উঠে দাঁড়ায় ডা. সাহানা। রোগীর কাছে গিয়ে থমকে যায়, হিম শীতল হয়ে যায় শরীর। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না বিছানায় অচেতন মানুষটির দিকে তাকিয়ে। কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু উনি এই ওয়ার্ডে কেন। নার্স রুমাকে সাহানা বলে, রোগীকে ওয়ার্ড থেকে নিজের কামরার পাশে যে কেবিনটা আছে সেখানে নিয়ে যেতে। কিন্তু রুমা রাজি হয় না। বলে, ম্যাডাম এর আগে উনি যতবার এসেছেন, ততবারই এই ওয়ার্ডে থেকেছেন। কেবিনে নেবার কথা বললে বলতেন, এখানে আমার প্রতিবেশিরা আছে। আশে পাশের সকল রোগীকে দেখে নিজের রোগটাকে নাকি নিছক তুচ্ছ মনে হয়। আর ওয়ার্ডের সকল রোগীকেই উনি নিজের আত্মীয় হিসেবে ভালোবাসেন।
রুমার কথা শেষ হতে না হতেই ডা. সাহানা বেশ গম্ভীর ও আদেশের সুরে বলে, আগে যা হওয়ার হয়েছে, এখন আমি বলছি উনাকে কেবিনে নিয়ে যেতে। পরে যা হয়, আমি দেখবো। অগত্যা রুমাসহ অন্যান্য নার্সরা মিলে রোগীকে কেবিনে নিয়ে যায়।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। স্যালাইন চলছে টিপ্ টিপ্ করে। চোখ খোলার চেষ্টা করে সোহাগ। কষ্ট হচ্ছে অনেক কিন্তু তাকাতে পারছে না। এক ঘরে একা একা। ড্রিম লাইট জ্বলছে কেন। এ আমি কোথায় এসেছি? মাথাটা যন্ত্রণায় ফেটে যাচ্ছে। অস্ফুট স্বরে বলে, রুমা মাথাটার দুই পাশটা ভালো করে টিপে দে না বোন। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। কি ব্যাপার রুমা কথা বলছিস না কেন? আমাকে কেবিনে নিয়ে এসেছিস কেন? ওয়ার্ডে কি বেড খালি ছিল না। কি রে কথা বলছিস না কেন? লাইটটা জ্বালিয়ে দে তো। সাহানা লাইট জ্বালিয়ে এবার কাছে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, কেমন আছিস এখন? নির্বাক বেকুবের মত তাকিয়ে থাকে সোহাগ সাহানার দিকে। চোখ কচলায় ভালো করে। যাকে দেখছে তা কি সত্যি? না কি মরীচিকা। কি রে এমন হাবলার মত তাকিয়ে আছিস কেন? আমি সাহানা।
-তুই ডা. সাহানা, তা তো বুঝলাম। কিন্তু এখানে কি করে-
-বিদেশ থেকে ডিগ্রীটা নিয়ে মাস তিনেক হলো এখানে যোগ দিয়েছি। কি অবাক হচ্ছিস? থাক সে সব কথা আগে এই ঔষুধগুলো খেয়ে নে।
-নার্স রুমা নেই রে এখানে?
-কেন আমার মাথা টিপা কি তোর ভাল লাগছে না?
-না না, তা না। তুই এখানকার ডাক্তার, আমার কেবিনে---
-ও নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। রুমাকে আমিই চলে যেতে বলেছি। ও থাকতে চেয়েছিল আমিই মানা করেছি। সারাদিন ডিউটি করেছে। বলেছি সকালে ডিউটির আগেই চলে আসতে। এবার ওঠ ঔষুধগুলো খেয়ে নে।
ঔষধ খাওয়ার পর জ্বরের তীব্রতাটা কমে এসেছে অনেকটা। তবে ঘুম ঘুম ভাবটা এখনো আছে। তাকাতে কষ্ট হচ্ছে। মাথার পাশে বসে সাহানা ক্রমাগত মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। রাত কত হবে কে জানে। সোহাগ অনুভব করে সাহানা ওর হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি ওর শরীরে। কিন্তু ও বাসায় না গিয়ে আমার পাশে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। রোগা শরীরের দুর্বল মনের কোণে ভেসে উঠে সেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের হাজারো স্মৃতি। ইচ্ছে করছে ওর মাথায় অন্য হাতটা রাখতে। কিন্তু পারছে না। স্যালাইনটা তখনও চলছে। এক অচেনা ভালো লাগার পরশে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে বলতে পারে না সোহাগ।
সকালে নার্স রুমার ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় সোহাগের। হাতের স্যালাইনটা খোলা হয়েছে কখন বুঝতেই পারেনি। মাথার কাছে রুমা চুলে হাত বুলাচ্ছে। এখন কেমন আছেন-জিজ্ঞেস করে রুমা। অস্ফুট কন্ঠে জানায়, এখন কিছুটা ভালো। তুমি কখন এলে?
-এইতো আধ ঘন্টা হলো। সাহানা ম্যাডাম আমাকে এখানে রেখে বাসায় গেছেন। বলে গেছেন এক ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবেন। আমি যেন সাড়ে সাতটায় আপনাকে জাগিয়ে তুলি। এর মধ্যে আপনি একটু ফ্রেস হতে হতেই ম্যাডাম এসে আপনাকে সকালের নাস্তা আর ঔষধ খাওয়াবেন।
আস্তে আস্তে বিছানা থেকে ওঠে ওয়াসরুমে যায় সোহাগ। বেশি করে পানি দিয়ে গোসল করে। বেড়িয়েই দেখে সাহানা এসে হাজির। পাউরুটির সাথে মাখন লাগাচ্ছে। কফি এনেছে বাসা থেকে। পরনের কাপড়, তোয়ালেসহ দরকারি সব জিনিষই নিয়ে এসেছে। রুমাকে বলে ওয়ার্ডের রোগীদের দেখে আসতে।
-এই নে, এগুলো পড়ে আরাম করে বস। কাপড় পড়তে গিয়ে নিজেকে ঠিক সামলাতে পারছিল না সোহাগ। ব্যালেন্স রাখতে কষ্ট হচ্ছে দেখে সাহানা নিজের কাঁধে সোহাগের হাতটা নিয়ে বিছানায় বসায়। চিরুনি দিয়ে মাথা আচরিয়ে দেয়। চিকিৎসকের ভালোবাসার আদরে যেন অসুখের মাত্রাটা অনেকটাই কমে আসে সোহাগের। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাহানার দিকে। সাহানার কোন ভাবাবেগ নেই। মাখন লাগানো পাউরুটি সোহাগের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, কষ্ট করে খেয়ে নে। এখুনি ঔষধ খেতে হবে। তারপর কফি খাবি দেখবি অনেক ভালো লাগছে।
পাউরুটি হাতে নিয়ে খেতে চেষ্টা করে সোহাগ। কিন্তু খেতে পারছে না। কেমন যেন বমি বমি লাগছে। সাহানার হাতটা শক্ত করে ধরে সোহাগ। বলে, খেতে ইচ্ছে করছে না রে। উত্তরে সাহানা বলে, খেতে ইচ্ছে না করলেও যে খেতে হবে। তা না হলে ঔষুধ খাবি কি করে। আচ্ছা ঠিক আছে তুই বস, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। সোহাগী হাতের খাবারও কেমন যেন অরুচি হচ্ছে। জ্বল হলে তো এমনটাই হয়। অল্প কিছু খাওয়ার পর একগাদা ঔষুধ সেবন করে সোহাগ। বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দেয়। সাহানা কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলে, কফিটা খা দেখবি অনেক আরাম লাগছে। কফি খেয়ে সত্যি সত্যি সোহাগ বেশ নিজে চাঙ্গা মনে করতে থাকে। আসলে সাহানা ডাক্তারতো, ও সব জানে। সাহানা বলে, এবার শুয়ে পড়, আমি তোর মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছি। কপালে রাখা সাহানার হাতে হাত রাখে সোহাগ। বলে, সাহানা........
-কি রে কিছু বলবি?
-হ্যাঁ।
-ঠিক আছে, আমি সব শুনবো। তার আগে তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।
-না বলছিলাম, তুই এখানকার ডাক্তার হয়ে আমার কাছে এভাবে....
-তোকে না বলেছি এ নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।
-তুই খেয়েছিস?
-হ্যাঁ। না মানে, আমি খাব এ নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। তুই চুপ করে শুয়ে থাকতো।
-আমার জন্য তুই এত কষ্ট করছিস, আমার খারাপ লাগছে।
-হয়েছে, আর একটিবারও এ কথা বলবি না, রোগী হয়ে এসেছিস রোগীর মতই থাক।
-তোর সাথে আমার কতদিন পর দেখা হলো রে সাহানা।
-চার বছর পাঁচ মাস সতের দিন। সাহানার কন্ঠরোধ হয়ে আসে। আর কোন কথা বলতে পারে না। ক্রমাগত শুধু মাথা টিপে চলেছে। কিছুক্ষণ পর বলে, এখন আর কোন প্রশ্ন করবি না। এ মুহুর্তে তোর সুস্থ হয়ে ওঠাটা জরুরী।
ঘুমিয়ে পড়েছে সোহাগ। সাহানা রুমাকে ডেকে সোহাগের পাশে থাকতে বলে নিজে ওয়ার্ডের রুগীদের দেখতে যায়। তিন চারটা ওয়ার্ড ভিজিট করে সাড়ে এগাড়টার দিকে ফিরে আসে কেবিনে। রুমাকে বলে, সাহানার বাসা থেকে দুপুরের খাবারটা নিয়ে আসতে। হাসপাতাল থেকে সাহানার বাসা বেশি দুরে না। মাত্র দশ মিনিটের পথ। রুমা খাবার নিয়ে সাড়ে বারটার মধ্যেই আবার ফিরে আসে। তখনও ঘুমাচ্ছে সোহাগ। জ্বরের মাত্রাটা বেশ কমে এসেছে। একটার সময় আবার ঔষধ খেতে হবে। এখনি জাগাতে হবে। কপালে হাত বুলাতে বুলাতে আস্তে আস্তে ডাকে সাহানা, সো হা গ, সো হা গ।
চোখ মেলে তাকায় সোহাগ। চোখের উপর সাহানার মুখ ঝাকিয়ে আছে। সোহাগ বলে-কি রে এখনো এভাবেই আছিস। তুই খেয়েছিস? না খাইনি, তুই ওঠ একসাথে খাব-সাহানা উত্তর দেয়। সোহাগ ওঠে মুখ ধুয়ে খেতে বসে। চিকন চাউলের ভাত, করলা ভাজি আর শিং মাছের ঝোল। সামনা সামনি দু’জন। মমতাভরা ভালোবাসায় খাবার তুলে দিতে দিতে বলে, তোর শরীরের যে অবস্থা তাতে তোর এখন এগুলোই খেতে হবে। আমি রোগী মানুষ, কিন্তু তুই তো আর রোগী না, তুই কিভাবে এসব খাবি-সোহাগ জবাব দেয়। সোহাগের রুগ্ন চোখের দিকে তাকিয়ে সাহানা বলে, তুই কি ভুলে গেছিস, কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কি রকম জ্বালাতন করেছিস আমাকে।
-মনে আছে। আর মনে আছে বলেই তো এতদিনও তোকে ভুলতে পারিনি। তোর মত বছর, মাস, দিনের হিসেব রাখতে না পারলেও অপেক্ষার প্রহর গুনেছি নিয়মিতই। আমি গেলাম রাঙ্গামাটি ফিরে এসে শুনি তুই লন্ডন চলে গেছিস। স্কলারশীপ পেয়েছিস সেতো জানতাম। আর যাবার কথাও ছিল এক মাস পর। ফিরে এসে তোদের বাসায় গিয়ে শুনি ত্ইু চলে গেছিস আগেই। এরপর একাধিকবার গিয়েও তোর কোন ঠিকানা সংগ্রহ করতে পারিনি তোর বাবার কারণে।
-আমি তো কিছুদিন পরই যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবার তাঁর ব্যবসার কাজে লন্ডনে যাবে। বলা নেই কওয়া নেই চারদিনের মাথায়ই আমাকে চলে যেতে হলো উনার সাথে। ঝুমা, তিথির মাধ্যমে তোর খবর নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ওরা বললো তুই আর তোর ভাইয়ের বাসায় নেই। কোথায় আছিস বলতে পারলো না। মাস চারেক হলো এসেছি, তোর বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হই। মাঝে মাঝে তোর গল্প পড়তাম পত্রিকায়। একবার পত্রিকা অফিসেও গিয়েছিলাম, ওরাও ঠিকানা দেয়নি। তুই নাকি মানা করেছিস কাউকে ঠিকানা দিতে। অসুবিধা কি এখনতো তোকে পেয়েছি। সাহানা খেয়াল করে সোহাগ সাহানার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক নেত্রে। কি রে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন, খাবার শেষ কর, ঔষুধ খেতে হবে।
খাবার শেষ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে থাকে সোহাগ। সাহানা টিফিন ক্যারিয়ার, প্লেট তুলে রাখছে। চিরচেনা সাহানাকে নতুন করে দেখছে সোহাগ। সেই একই রকম আছে। আগে কথা কম বলতো বলে কত ক্ষ্যাপাতাম ওকে। কিন্তু কখনোই বিরক্ত হতো না। শুধু মিষ্টি করে হাসতো। সাহানা ফিরে তাকায় সোহাগের দিকে, বলে-কি রে বসে রইলি যে, শুয়ে পড়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেই এখন একটু ঘুমিয়ে পড়। বিকেলে খাওয়ার জন্য তোর সেই প্রিয় নুডুলস রান্না করতে বলেছি মাকে। তোকে যে খাওয়াব তাও বলেছি।
-দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, অনেক দিন হয় জিনিষটা খাই না।
-তোর মনে আছে, আমি ক্যাম্পাসে নুডুলস নিয়ে গেলেই তুই কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলতি। আমিও ইচ্ছে করেই নুডুলস নিয়ে যেতাম তোর দুষ্টমি দেখতে। তোর দুষ্টমি যে আমার কাছে অম্ভব প্রিয় ছিল তা কিন্তু তোকে আমি বুঝতে দিতাম না।
-সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একবার তোর বন্ধুদের সামনেই আমার কপাল টিপিয়েছিলাম। বলেছিলাম তুই কপাল টেপার ডাক্তার হলে ভালো করবি।
-হ্যাঁ, সেদিন তোর শরীরে জ্বর অনুভব করেছিলাম। কিন্তু তুই বলিসনি। আর তোর কপাল টেপার পর থেকেই বন্ধুরা সবাই আমাকে কপাল টেপার ডাক্তার বলে ক্ষ্যাপাতো। অনেকে আবার ‘এস এস’ বলে ডাকতো। দ্যাখ আমি নিজেই বক বক করে যাচ্ছি। আর কোন কথা বলব না, এবার তুই শুয়ে পড়।
-আমার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। এখন অনেকটা ভালো লাগছে। আচ্ছা তুই বিয়ে করিসনি? তোর বাবা না তাঁর বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে দিবে বলেছিল।
-হ্যাঁ। কিন্তু গত বছর বাবা মারা যাওয়ার পর আর ছেলেটি আমার কাছে আসতে সাহস পায়নি। কারণ, ওকে আমি তোর কথা বলেছিলাম।
-আমার কথা বলেছিলি? কিন্তু এতদিনেও তো তুই আমাকে কখনোই একবারের জন্যও বলিসনি!
-তোকে চমকে দেবো বলে বলা হয়নি। আমার মনে কেন যেন একটা প্রচন্ড বিশ্বাস জন্মেছিল তোর প্রতি। অন্তত তুই আমাকে ঠকাবি না। আর সেই বিশ্বাস থেকেই ভেবেছি তোকে আমি সময় মতোই বলবো। তোকে সারপ্রাইজ দেবো। আচ্ছা তুই কি বিয়ে করেছিস? চমকে উঠে সোহাগ। আর বিয়ে-বলতেই সাহানা থামিয়ে দেয় সোহাগকে। থাক আর বলতে হবে না।
মুখের জবান বন্ধ হয়ে যায় সোহাগের এক অজানা আশংকায়। সাহানার এহেন বিশ্বাস ওকে মুহুর্তের মধ্যেই স্তব্ধ করে দেয়। সোহাগ নিজেও সাহানাকে না দেখলে কেমন ছটফট করতো। নিজের ক্লাশ বাদ দিয়ে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে বসে থাকতো। ক্লাশ থেকে বের হলেই পাগলের মত দৌড়ে যেত সাহানার কাছে। সোহাগ-সাহানা ইন্টারমিডিয়েটও একই সাথে পড়েছে। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব। সোহাগের লেখালেখির অভ্যাসটা ছিল তখন থেকেই। সাহানা ছিল ওর লেখার একনিষ্ঠ পাঠক।
দেখতে দেখতে দু’দিন পার হয়ে যায়। সাহানার চিকিৎসা আর সেবায় সোহাগ এখন অনেকটাই সুস্থ। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ হাত ধুঁয়ে রুমের মধ্যে একাকী পায়চারি করছে। সাহানা আটটার মধ্যেই আসবে বলে বাসায় গেছে। বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। আটটা বাজতে এখনো এখনো কুড়ি মিনিট বাকি। সময় এত দেরীতে চলছে। আটটা বাজার দশ মিনিট আগেই সাহানা সোহাগের কেবিনে প্রবেশ করে। হাতে একটা জাতীয় দৈনিক পত্রিকা আর একগোছা রজনীগন্ধা। হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে, দ্যাখ পত্রিকায় আজ তোর ‘বৃষ্টি¯œাত কান্না’ গল্পটি ছাপা হয়েছে। পত্রিকাটি হাতে নেয় সোহাগ। পরক্ষণেই সাহানার দিকে পত্রিকাটি বাড়িয়ে দিয়ে বলে, তুই পড়।
-আমি এক নি:শ্বাসে পড়েছি। লিখেছিস তো আমাকে নিয়েই। খালি নামটা অন্য। আমি কিছু বুঝি না মনে করেছিস।
-তোর ভালো লেগেছে?
-না লাগেনি। তোর গল্পে লেখা কথাগুলো আমাকে আগে বলিসনি কেন?
-তুইও তো বলিসনি তোর মনে কথা।
অভিমানী সাহানার চেহারায় রংধনুর রেখা উঁকি দেয়। কোন কথা বলে না। টিফিন ক্যারিয়ার থেকে মুরগির স্যুপ আর রুটি বের করে টেবিলে রাখে। আয় আগে খেয়ে নে, ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে। নাস্তা খেয়েই বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে সোহাগ। সাহানা বলে, কি রে ঔষধ খাবি না। এই নে, ঔষধটা খেয়ে নে। সোহাগ ঔষধগুলো হাতে নিয়েই জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। সাহানা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, এটা কি হলো।
-আমি আর ঔষধ খাব না।
-মানে।
-আমার আর সুস্থ হতে ইচ্ছে করছে না।
-বুঝলাম না।
-হয়েছিস ডাক্তার, করছিস সেবিকার কাজ আমার কাছে খুব ভালো লাগছে।
সাহানা সোহাগের বিছানায় গিয়ে বসে। মাথা নিচের বালিশ সরিয়ে নিজের কোলের উপর সোহাগের মাথাটা রেখে কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, অন্য সব রোগীর কাছে আমি ডাক্তার হলেও তোর কাছে না হয় সেবিকা হয়েই থাকবো।


(৭ই মে, ১৮৬১ - ৭ই আগস্ট, ১৯৪১) (২৫শে বৈশাখ, ১২৬৮ - ২২শে শ্রাবণ, ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) বাংলার দিকপাল কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও দার্শনিক। তিনি গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় নন্দিত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতে রবীন্দ্রনাথ এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা করেন। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। নোবেল ফাউন্ডেশন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটিকে বর্ণনা করেছিল একটি "গভীরভাবে সংবেদনশীল, উজ্জ্বল ও সুন্দর কাব্যগ্রন্থ" রূপে। রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল কলকাতার এক পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে।মাত্র আট বছর বয়সে তিনি প্রথম কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হন। ১৮৭৭ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে "ভানুসিংহ" ছদ্মনামে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রথম ছোটোগল্প ও নাটক রচনা করেন এই বছরেই। রবীন্দ্রনাথ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। তাঁর মতাদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর বিচিত্র ও বিপুল সৃষ্টিকর্ম এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশ্বভারতীর মধ্য দিয়ে। বঙ্গীয় শিল্পের আধুনিকীকরণে তিনি ধ্রুপদি ভারতীয় রূপকল্পের দূরুহতা ও কঠোরতাকে বর্জন করেন। নানান রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিষয়কে উপজীব্য করে রচিত হয়েছে তাঁর উপন্যাস, ছোটোগল্প, সংগীত, নৃত্যনাট্য, পত্রসাহিত্য ও প্রবন্ধসমূহ। তাঁর বহুপরিচিত গ্রন্থগুলির অন্যতম হল গীতাঞ্জলি, গোরা, ঘরে বাইরে, রক্তকরবী, শেষের কবিতা ইত্যাদি। রবীন্দ্রনাথের কাব্য, ছোটোগল্প ও উপন্যাস গীতিধর্মিতা, সহজবোধ্যতা, ধ্যানগম্ভীর প্রকৃতিবাদ ও দার্শনিক চিন্তাধারার জন্য প্রসিদ্ধ। তাঁর রচিত গান আমার সোনার বাংলাজনগণমন-অধিনায়ক জয় হে যথাক্রমে বাংলাদেশ ও ভারত রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত।

No comments:

Post a Comment